বাহরুল উলূম শাহ্সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ছাহেব (রহঃ) ছিলেন এক কালজয়ী প্রতিভা।

বাহরুল উলূম শাহ্সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ছাহেব (রহঃ) ছিলেন এক কালজয়ী প্রতিভা। 

(বিস্তারিত জীবনী)

জ্ঞানে গুণে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও আরবি ভাষাবিদ হিসেবে তিনি সর্বজন প্রশংসিত। তাঁর কাব্যিক প্রতিভাও ছিল অসাধারণ। হক্কানী আলেম, বিখ্যাত ওয়ায়েজ বা বক্তা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এরূপ বড় বড় পরিচয়, খ্যাতি ছাড়িয়ে তিনি একজন কামিল পীর হিসেবেই সর্বত্র পরিচিত। মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও আল্লাহ্র অলি হিসেবে সর্বশ্রেণির লোকের নিকট তিনি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। একই সাথে ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, দেশ দরদি এবং সমাজসেবক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল সমধিক। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।

জন্ম ও বংশ পরিচিতি :

মাওলানা শাহ মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ছাহেব (রহ.) উপমহাদেশব্যাপী পরিচিত দক্ষিণ-পূর্ব ‘বাংলার’ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের অদূরে বৃহত্তর সাতকানিয়া (বর্তমান লোহাগাড়া) উপজেলার অন্তর্গত আধুনগরস্থ সুফি মিয়াজি পাড়ায় ১৯৩৮/৩৯ খ্রিস্টাব্দে এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মরহুম মুসলেহ উদ্দিন এবং মাতা মরহুমা রায়হানাহ্ বেগম। তাঁর পিতা ছিলেন লোহাগাড়া থানাধীন ঐতিহ্যবাহী চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসার একজন সুযোগ্য শিক্ষক। তাঁর মাতা চরিত্রবতী ও পর্দানশীন অত্যন্ত পরহেজগার মহিলা ছিলেন।

শিক্ষাজীবন :

মাওলানা শাহ মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন যেহেতু শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, তাই ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ, তীক্ষ্ণ মেধাবী ও চিন্তাশীল ছিলেন। তিনি চার বছর বয়সেই স্বীয় মাতার কাছে হরফে আউয়াল তথা প্রথম অক্ষরের শিক্ষা লাভ করেন। পিতার কাছে আরবি-ফারসি-উর্দু-বাংলা ইত্যাদির প্রাথমিক পাঠ সমাপন করেন। তিনি পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হিসেবে অতি আদরে লালিত-পালিত হন। কিন্তু আদর্শ ছাত্রের স্বভাব-চরিত্রের গণ্ডি তিনি কখনো অতিক্রম করেননি। আচার-ব্যবহারে কখনো সীমালঙ্ঘন করেননি। পারিবারিক কাজে-কর্মে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেন। মা ছাড়াও বড় বোনকে বেশি বেশি মান্য করতেন। অতঃপর তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন চুনতি হাকিমিয়া সিনিয়র (বর্তমানে কামিল) মাদরাসায় ভর্তি হন। পূর্বেই বলেছি, তাঁর পিতা ছিলেন এ মাদ্রাসার সুযোগ্য শিক্ষক। ছাত্র জীবনে তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। কোন কিছু তাঁর চোখের সামনে একবার পড়লে তা আর কখনো ভুলতেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি অতি প্রখর ছিল। যা পরবর্তী জীবনে পরিলক্ষিত হয়। ৩০/৪০ বছর পূর্বের ঘটনাও হুবহু বর্ণনা করতে পারতেন। ব্যক্তির সাথে সাথে তার বাবার নামও বলে দিতে পারতেন।

তিনি চুনতি হাকিমিয়া সিনিয়র মাদরাসার সেরা ছাত্রদের তালিকায় নিজের স্থান করে নেন। এ মাদরাসা থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে হাফতুম (দাখিল) কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর ছাত্র জীবনের একান্ত সহপাঠী প্রফেসর ড. শব্বির আহমদ বলেন, “জামাতে ‘হাফতুম’ এর সরকারি বোর্ড পরীক্ষায় মন্দ ফলাফল বন্ধু বৎসল ও চিত্তহারী এ বালকের সাথে মানানসই না হওয়ায় জামাতে ‘শুসুম’ এ তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে, তখন থেকেই তিনি শ্রেণি পরীক্ষায় ঈর্ষাযোগ্য আসন লাভ করতে থাকেন।” তাঁর বাংলা, আরবি ও উর্দু হস্তাক্ষর ছিল সুন্দর-পরিচ্ছন্ন।

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে একই প্রতিষ্ঠান হতে ছুয়াম (আলিম) ১ম বিভাগে ১৬তম স্থান এবং ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে উলা (ফাযিল) ১ম বিভাগে ৫ম স্থান অধিকার করে বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। চুনতি হাকিমিয়া সিনিয়র মাদরাসায় তাঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের, মাওলানা মোজাফফর আহমদ, মাওলানা মুহাম্মদ আমীন, মাওলানা রশিদ আহমদ, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম প্রমুখ অন্যতম।

উচ্চশিক্ষা ও কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল :

মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন হাদিস বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উম্মুল মাদারিস (মাদরাসা সমূহের জননী) খ্যাত চন্দনপুরা চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। এ মাদরাসায় অধ্যয়নকালে তিনি ‘কালের সেরা ছাত্র’ ও ‘মাদরাসার গৌরব’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে কামিল (হাদিস) ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করায় ‘গোল্ড মেডেল’ লাভ করেন। এ ঈর্ষণীয় ফলাফল লাভের সুবাদে পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক তাঁকে দু’বছর সময়কাল গবেষণা করার জন্য বৃত্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেননি। দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায় তাঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা ফজলুর রহমান, ফখরুল মুহাদ্দেসিন মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ আমীন, মাওলানা আবুল ফছীহ মুহাম্মদ ফুরকান, প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আবদুল মন্নান, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামি ও মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল আরকানি প্রমুখ খ্যাতিমান মুহাদ্দিসগণ।

বাহরুল উলূম উপাধি লাভ:

কামিলে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করার পর তাঁর পরম শ্রদ্ধাভাজন পীর-মুর্শিদ হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রহ.) এর নিকট দোয়া নিতে এলে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে সেদিন বাদে জুমা মাদারবাড়িস্থ তাঁর বাংলায় (ইবাদতখানা) উপস্থিত সবাইকে মিষ্টি মুখ করান এবং তাঁর কারুকার্যখচিত টুপিটি স্বহস্তে মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিনের মাথায় পরিয়ে দেন। তাঁর ব্যবহৃত সাদা রুমালখানা দ্বারা মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিয়ে ‘বাহরুল উলূম’ (বিদ্যাসাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। তবে উক্ত উপাধিটি তাঁর উভয় পীর-মুর্শিদদ্বয়ের জীবদ্দশায় বেশি প্রসিদ্ধি লাভ না করলেও তাঁদের ইন্তিকালের পর তা ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তবে প্রফেসর ড. আহসান সাইয়েদ তাঁর ‘বাহরুল উলূম শাহসূফি হযরত মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.)’ প্রবন্ধে বলেন, ‘আরবি ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য সর্বজন প্রশংসিত। তিনি এমন সহজ সাবলিলভাবে অনর্গল আরবিতে কথা বলেন এবং লেখেন যা দেখলে মনে হয় আরবি যেন তাঁর মাতৃভাষা। একই সাথে উর্দু এবং ফারসি ভাষায়ও তিনি সমান পারদর্শী। তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) এ সকল বিষয়ে তাঁর রয়েছে গভীর জ্ঞান। তাঁর জ্ঞান গরিমায় মুগ্ধ হয়ে দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ তাঁকে ‘বাহরুল ‘উলূম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

শাদি মুবারক :

১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি সাতকানিয়া থানার দক্ষিণ রামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত আলিম ও হাকিম মরহুম মাওলানা শফিক আহমদ সাহেবের তনয়া বর্তমান ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি.সি. প্রফেসর ড. আহসান সাইয়েদ (আহসান উল্লাহ) এর বড় বোন মোছাম্মৎ তাহেরা বেগমের সাথে শুভ পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর সকল সন্তান এ স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ। অবশ্য জীবনের প্রথমে তিনি যে বিয়ে করেছিলেন তা মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্গে যায়।

বায়‘আত হওয়া :

মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ছাত্রজীবন থেকে বাহ্যিক জ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কেননা তিনি মনে করেন, ইসলামি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মনের যাবতীয় পাশবিকতা দমন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। তা না করতে পারলে সকল পরিশ্রমই নিষ্ফল। তাঁর মনে এই আধ্যাত্মিক শূন্যতা দূরীকরণার্থে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র পঞ্জুম (দশম) শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ছুটে যান আখতরাবাদ কুমিরাঘোনা ঈছালে ছাওয়াব মাহফিলে। মসজিদ বায়তুশ শরফে মাগরিবের নামায আদায় করে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় তিনি বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম শাহসূফি হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রহ.) এর হাতে বায়‘আত হন। এ সময় হযরত কেবলা জানতে পারেন তাঁর নাম হারুন। তিনি তাঁর সামনে দণ্ডায়মান ভবিষ্যত এক আল্লাহর অলির ছায়া এই বালকের চেহারায় দেখতে পান। তাৎক্ষণিকভাবে বলেন, বাবা তুমি হারুন নও, কুতুব উদ্দিন। সে থেকেই তিনি দ্বীনের কুতুব।

৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বীয় পীর-মুর্শিদ শাহ্ আখতর সাহেব পবিত্র মক্কায় জীবনের ২৯তম হজ্ব পালন শেষে ইন্তেকাল করায় তাঁরই সুযোগ্য খলিফা শাহ মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করলে, তিনি তাঁর হাতে পুনরায় বায়‘আত নবায়ন করেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে থেকে দরবারের সার্বিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে শাহ্ আবদুল জব্বার সাহেবকে সর্বাত্মক সঙ্গ ও সহযোগিতা প্রদান করেন। উল্লেখ্য, শাহ্ আখতর (রহ.) এর ইন্তেকালের সময় শাহ্ কুতুবও তাঁর হজ্ব সাথী ছিলেন।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন :

প্রবাদ আছে যে, Morning shows the day অর্থাৎ ‘সকাল বেলার সূর্যই বলে দেয় দিনটি কেমন যাবে।’ তেমনি মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) এর শৈশব ও যৌবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি ভবিষ্যত কর্মজীবনে মহত্ত্বর এক শীর্ষস্থানের অধিকারী হবেন। ছাত্রজীবনেই তাঁর মধ্যে বিশ্বস্ততা, সাধুতা, সময়ানুবর্তিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধৈর্যশীলতা, সত্যানুরাগিতা প্রভৃতি মহৎ গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বস্তুত তাঁর এই মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতাই তাঁকে মহত্ত্বের উচ্চ শিখরে পৌঁছতে সাহায্য করে। কামিল পাশ করার পর তাঁর অন্যান্য বন্ধুবর্গের (ড. শব্বির আহমদ)-এর ন্যায় স্কুল-কলেজে পড়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর আধ্যাত্মিক ওস্তাদ তথা শ্রদ্ধেয় পীর-মুর্শিদ হযরত কেবলা মীর মোহাম্মদ আখতর সাহেবের নির্দেশে এবং শ্রদ্ধাভাজন ওস্তাদ মরহুম হেড মাওলানা জনাব মোজাফফর আহমদ সাহেবের আন্তরিক পরামর্শে তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সাতকানিয়া থানার রসুলাবাদ সিনিয়র মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা, জ্ঞানের গভীরতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বিবেচনা করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদায়ন দেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে মাদরাসার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। এ সময় একজন তরুণ ওয়ায়েজিন হিসেবে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে তিনি রসুলাবাদ মাদরাসার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন এবং বায়তুশ শরফ দরবারের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে পীর-মুর্শিদ হযরত কেবলার সার্বক্ষণিক সাহচর্য গ্রহণ করে দীর্ঘ সময়কাল আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন করেন।

১ জানুয়ারি, ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বায়তুশ শরফ আদর্শ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবৈতনিকভাবে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে ১ জুন, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় শিক্ষকবৃন্দের অকৃত্রিম সহযোগিতায় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ‘বায়তুশ শরফ আদর্শ মাদরাসা’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক চট্টগ্রাম বিভাগে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মরহুম পীর শাহসূফি হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হতে অবসর গ্রহণ করে রেকটর পদে উন্নীত হলে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসা পরিচালনা পরিষদ তাঁর প্রশাসনিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করে তাঁকে অধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি দান করেন। ২০০০ সালে তিনি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গোল্ড মেডেল, সনদপত্র ও নগদ অর্থ পুরস্কার লাভ করেন। ঐ বছর বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা ২য় বারের মত শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরস্কৃত হয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ৩১ ডিসেম্বর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসর নেয়ার কথা থাকলেও সরকার বিশেষ বিবেচনায় চাকুরির মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধি করে দেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেও অবৈতনিক স্বেচ্ছাসেবী ওস্তাদ হিসেবে বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার ছাত্রদেরকে বুখারি শরীফ ও মুসলিম শরীফসহ অন্যান্য বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের (গভর্নিং বডির) সম্মানিত সভাপতি ও সহ-সভাপতি হিসেবে ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শাহ্ কুতুব উদ্দিন (রহ.) মাদরাসার সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ সাহেবের ইন্তেকালের পর ২০ নভেম্বর, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ১৩ জানুয়ারি, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর শরি‘আহ সুপারভাইজরী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এছাড়াও তিনি আরো বহু দ্বীনি, সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ :

২৫ মার্চ, বুধবার ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পীর মুর্শিদ শাহসূফি হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করলে, প্রয়াত পীর-মুর্শিদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে এপ্রিল ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ-এর সভাপতি এবং বায়তুশ শরফের পীর হিসেবে খিলাফতের দায়িত্বভার তাঁর স্কন্ধে অর্পিত হয়। তাঁর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মাসিক মদীনার সম্পাদক হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, ‘মওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেব একজন বিজ্ঞ আলিম, সূফি ও স্বভাব কবি। তীক্ষ্ণ মেধা, অপরিমেয় সাধনা ও যামানার হাদি শাহসূফি হযরত মওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.)-এর যোগ্য উত্তরাধিকারী রূপে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন বলে সকলে আশাবাদী।

শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ :

জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ১৯৯৮ উপলক্ষে তিনি চট্টগ্রাম জেলার ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান’ (অধ্যক্ষ) এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তিনি জাতীয়ভাবে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান’ (অধ্যক্ষ) নির্বাচিত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা থেকে তিনি ‘স্বর্ণ পদক, নগদ অর্থ ও সনদপত্র’ লাভ করেন। সাথে সাথে তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় ও নিবিড় তত্ত্বাবধানে বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা ২য় বারের মত শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয়ভাবে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ হওয়ার গৌরবময় স্বীকৃতি লাভ করে এবং পুরস্কৃত হয়। তাঁর দোয়ায় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৮ সালে ৩য় বারের মত বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্স-মাস্টার্স) মাদরাসা জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সম্মানিত অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. সাইয়েদ মুহাম্মদ আবু নোমান শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে সনদপত্র ও নগদ অর্থ পুরস্কার লাভ করেন।

শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড :

শাহ্ মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন সাহেবের গতিশীল নেতৃত্বে ‘বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ’ একটি ধর্মীয়, সামাজিক ও তমদ্দুনিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তাঁর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও তড়িৎ কর্মদক্ষতার ফলে বায়তুশ শরফের বহুমুখী কার্যক্রম সুবিস্তৃত হয়েছে প্রতিনিয়ত। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো- (১) বায়তুশ শরফ মসজিদ- ১০০টি, (২) মাদরাসা- ১৫টি, (৩) এতিমাখানা- ০৭টি, (৪) হেফজখানা- ১২টি (৫) হাসপাতাল- ০৩টি (৬) আরাকান রোড থেকে কুমিরাঘোনা মাহ্ফিলে যাওয়ার প্রবেশপথ চুনতী বাজারে সুদৃশ্য মজবুত তোরণ (বাবে মীর আখতর)-০১টি। এছাড়া আরো বহু মাদরাসা, মসজিদ ও এতিমখানা নির্মাণাধীন রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বায়তুশ শরফের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় দু’শরও অধিক উন্নয়নমূলক ও সংস্কারধর্মী কর্মকাণ্ড তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর আমলে উত্তরবঙ্গের ঈশ্বরদী, পাবনা; কাহলু কাজীপাড়া, বগুড়া; বটতৈল, কুষ্টিয়া; সাহাব্দিপুর, গোদাগাড়ী, রাজশাহী; সাভার, ঢাকা; সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কক্সবাজার ও ঢাকা বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স; কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চলে বায়তুশ শরফ মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, হেফজখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

দক্ষ মানুষ গড়ার কারিগর :

কর্মীর দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। তিনি নিজেই একজন দক্ষ প্রশাসক ও প্রশিক্ষক ছিলেন। সে হিসেবে তরিকতপন্থী আলেমে দ্বীন, মুবাল্লিগ ও তরিকতের অনুসারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ কল্পে বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.) কুরআন-হাদিস, শরি‘আত-তরিকত, হাকিকত-মা‘রিফত এর অপূর্ব মিলন ঘটিয়ে ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় ৪টি তা‘লিমি সপ্তাহের ব্যবস্থা করেন, সে তা‘লিমি সপ্তাহের ধারাবাহিকতার প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুশ শরফ, আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ২৪ হতে ২৯ জুলাই ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাহ্ মাওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেবের একক পরিচালনায় সপ্তাহব্যাপী এক ফলপ্রসূ তা‘লিমি সপ্তাহের আয়োজন করেন। সারা দেশ থেকে নির্বাচিত প্রায় ৫০০ জন তরিকতপন্থী ‘আলিম-‘উলামা, ছাত্র-শিক্ষক ও বায়তুশ শরফের ভক্ত-অনুরক্ত এতে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিদিন ৪টি অধিবেশনে তা‘লিম-তরবিয়ত অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রশিক্ষক ছিলেন স্বয়ং পীর ছাহেব হুজুর। জিকির ও সালাতুত তাহাজ্জুদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুশ শরফের সদ্য মরহুম খতিব আলহাজ্ব মাওলানা নুরুল ইসলাম সাহেব। এটি ছিল বায়তুশ শরফের ৫ম তালিমি সপ্তাহ। এছাড়া তিনি ২০১৭ ও ২০১৯ সালে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আরও দু’বার তালিমি সপ্তাহের ব্যবস্থা করেন।

জ্ঞানীগুণীদের পৃষ্ঠপোষক :

ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশেও শাহ্ মাওলানা কুতুব উদ্দিন ছাহেবের অবদান অনন্য। পীর-মুর্শিদের পূর্বধারা অব্যাহত রেখে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরের ধনিয়ালাপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুশ শরফ প্রাঙ্গণে প্রতি বছর চার দিনব্যাপী অত্যন্ত শান-শওকতের মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে ‘তামাদ্দুনিক প্রতিযোগিতা’ নামে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ ‘ইসলামি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা’। যাতে দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতি বছর সহস্রাধিক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল পাখপাখালির আসর ও শানে মোস্তফা মাহফিল। শিক্ষা, চিকিৎসা ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর ৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেওয়া হয় গুণীজন সংবর্ধনা। তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশের সেরা গুণী ৯০ জন ব্যক্তিত্বকে সংবর্ধনা ও ‘বায়তুশ শরফ স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয়।

কাব্যিক প্রতিভা :

হযরত মাওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেব (রহ.) ছিলেন একজন স্বভাবজাত কবি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও অনুষ্ঠানে আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় উপস্থিত স্বরচিত কবিতা পাঠ করে তিনি হয়েছেন প্রশংসিত ও নন্দিত। শেষরাতে, বিকেলে বা অবসর মুহূর্তে তিনি কবিতা লিখতেন। এক বা দু’টি কলম বুক পকেটে এবং একটি নোট বই সবসময় তাঁর সাথে থাকতো। তাঁর বহু কালোত্তীর্ণ হামদ, না‘ত পবিত্র মক্কায় কা’বার চত্বরে ও মদীনায় মসজিদে নববীর চত্বরে লেখা; যেগুলো গুলহায়ে আকীদত কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর বহু উর্দু, ফারসি ও আরবি কবিতা বহুল প্রচারিত মাসিক দ্বীন দুনিয়া, আল-আছরার, আলো, আনজুমনসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘গুলহায়ে আকীদত’ নামে উর্দু ভাষায় একটি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাতে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর স্বরচিত প্রায় ৫০০ দুর্লভ কবিতা স্থান পেয়েছে।

ওয়াজ-নসিহত :

ওয়াজ-নসিহতে তিনি এক কিংবদন্তী। প্রথিতযশা আলিমে দ্বীন, মুহাদ্দিস ও সুবক্তা হিসেবেও দেশ-বিদেশে রয়েছে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি। অত্যন্ত সহজ সরলভাবে কুরআন-হাদিস, ইসলামের ইতিহাস ও মনীষীদের আরবি, উর্দু ও ফারসি বয়েত ও শ্লোকের মাধ্যমে যুক্তি সহকারে হৃদয়গ্রাহীভাবে মানুষের কাছে তিনি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। তাঁর ওয়াজের স্টাইল ছিল একান্তই তাঁর নিজস্ব। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি খুবই প্রখর। তাঁর সুমধুর বচন আর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা উপস্থিত সবাই নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকতো, দেখলে মনে হতো যেন তাদের মাথার ওপর পাখি বসে আছে। তাঁর ওয়াজ শুনে হাজারো মানুষ হিদায়াতের পথে এসে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে। আল্লামা ইকবাল (রহ.)-এর এ কবিতাটি তিনি প্রায় সময় সুমধুর সুরে পড়েন- ‘হে আল্লাহ্! মুসলমানদের অন্তরে সেই জীবন্ত আশা সৃষ্টি করে দিন, যা প্রাণকে আন্দোলিত করে এবং অন্তরকে উষ্ণতা দান করে।

পবিত্র শবে বরাত, পবিত্র শবে কদর, আখতরাবাদ (কুমিরাঘোনা) মাহ্ফিলে ঈছালে ছাওয়াব, কক্সবাজার ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম মাহ্ফিলে তাঁর হৃদয়কাড়া ঐতিহাসিক মুনাজাতে লক্ষ লক্ষ মুমিন-মুসলমান পরম ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে শরীক হতেন।

আর্তমানবতার সেবায় :

শাহ্সূফি মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) ছিলেন কোমল হৃদয়ের লোক। মানুষের সুখে সুখী হওয়া এবং দুঃখে দুঃখী হওয়া তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দুঃখী মানুষের করুণ অবস্থা দেখলে তাঁর হৃদয়-মন ব্যাকুল হয়ে উঠতো। আর্ত মানবতার সেবায় দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এ প্রত্যক্ষ সবক তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর পীর মুর্শিদ শাহ্ আবদুল জব্বার (রহ.) এর কাছ থেকে। এজন্য তিনি পীর হিসেবে বায়তুশ শরফের দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বায়তুশ শরফের স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরায় বন্যা দুর্গতদের মাঝে ব্যাপক ত্রাণ বিতরণে তৎপরতা চালান। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলাসহ মধ্যাঞ্চলের ৪১টি জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রলয়ংকরী বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লে তিনি বায়তুশ শরফের ভক্ত-অনুরক্ত এবং সর্বস্তরের মুমিন মুসলমানদের নিকট থেকে কয়েক লক্ষ টাকার ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকায় গমন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ঢাকার সাভারের অদূরে ধামরাই উপজেলা এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলাধীন কাঁচপুর এলাকায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের হাতে হাতে তিনি স্বহস্তে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেন। এছাড়াও তিনি দেশের এ বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি লাভের জন্য বায়তুশ শরফ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে খতমে বুখারি শরীফ, খতমে কুরআন শরীফ ও খতমে খাজেগানসহ বিভিন্ন দোয়া মাহ্ফিলের ব্যবস্থা করেন। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। প্রাণঘাতি মহামারী করোনাকালীন লকডাউন চলাকালীন গত মার্চ মাসের শেষের দিকে ধনিয়ালাপাড়া ও সুপারিওয়ালাপাড়ার অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেন। সদলবলে সশরীরে তিনি ১০ লক্ষাধিক টাকার ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে কক্সবাজার গমন করেন।

দানশীলতা :

আমাদের দেশের সাধারণ নিয়ম হলো পীর-মুর্শিদরা হাদিয়া গ্রহণ করেন সঞ্চয়ের জন্য, আর বায়তুশ শরফের সদ্য মরহুম পীর সাহেব (রহ.) তাঁর পূর্ববর্তী পীর মুর্শিদদ্বয়ের অনুসরণে হাদিয়া-তোহফা গ্রহণ করেছিলেন দান করার জন্য। অথচ সংকীর্ণতার নাগপাশে আবদ্ধ এ দেশের অধিকাংশ আলেম সমাজ শুধুমাত্র ‘দান গ্রহণ কর হে, না করিবে দান’ এ নীতির জন্য সর্বকালে সমালোচিত। তাছাড়া জনগণের মুখে প্রবাদ আছে ‘মোল্লারা শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না’ কিংবা ‘পীর সাহেবরা মুরীদি ব্যবসা করে কোটি টাকার মালিক হবার জন্য।’ কিন্তু এখানেই শাহ্ কুতুব উদ্দিন (রহ.) এর ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র পরিলক্ষিত হয়। তিনি এ সমস্ত প্রবাদের ঊর্ধ্বে উঠে দানশীলতার এক অনন্য নজীর স্থাপন করে গিয়েছেন। মুরিদরা তাঁকে হাজার টাকা হাদিয়া দিয়েছেন কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষ, গরিব-দুঃখী, বিধবা, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, এতিম ছাত্র ও অভাবীদেরকে প্রকাশ্যে ও গোপনে লক্ষ লক্ষ টাকা দান করেছেন। তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ হাদিস প্রায়ই বলতেন যে, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা সাত শ্রেণির মানুষকে তাঁর আরশের নিচে ছায়া দান করবেন, যে দিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ হল যারা নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর রাস্তায় দান করেন।’ বা’দ ফজর থেকে বা’দ এশা পর্যন্ত তাঁর এই দান-অনুদান কার্যক্রম চলতেই থাকতো। কত বড় হৃদয়ের অধিকারী হলে এইরূপ দানের উৎসব সারা বছর চালিয়ে যেতে পারেন!

স্বভাব-চরিত্র ও চারিত্রিক মাধুর্য :

শাহ্সূফি মাওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, মহানুভব, বলিষ্ঠ চরিত্র ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক মহান আধ্যাত্মিক সাধক। তাঁর মধ্যে আল্লাহ্ প্রদত্ত বহুবিধ প্রতিভার অন্যতম একটা দিক হল নেতৃত্বদানের অসাধারণ যোগ্যতা। তিনি অনেক বড় বড় মাহফিল একক নেতৃত্বেই সম্পন্ন করে গিয়েছেন। তাঁর পীর-মুর্শিদের রেখে যাওয়া প্রতিটি অনুষ্ঠান তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সুন্দর ও সুচারুরূপে প্রতিপালনের চেষ্টা করে গিয়েছেন। আল্লামা ইকবালের ভাষায়, ‘কাফেলার নেতা হবেন উঁচু ও উদার দৃষ্টির অধিকারী। তাঁর কথামালা হবে হৃদয়গ্রাহী, তাঁর অন্তর হবে দরদ ও ব্যথায় ভরা। এগুলো হচ্ছে সঠিক আমীরে কাফেলার সফরের পাথেয়।

তাঁর এখলাস, ক্ষমা প্রদর্শন, মহানুভবতা, সহিষ্ণুতা, পরোপকারিতা, সত্যবাদিতা, বদান্যতা, আতিথেয়তা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং আদর্শ স্থানীয়। তিনি অত্যন্ত কোমল ও বিনয়ী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। বিনয় তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। তাঁর এ স্নেহপূর্ণ আচরণ ও অনুপম ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে মধুমক্ষিকার ন্যায় মানুষ তাঁর কাছে ছুটে আসতো। তিনি ছিলেন আদর্শ চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে তিনি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ব্যথিতের বেদনা উপলব্ধি করতে পারতেন এবং তা দূর করার জন্য সবসময় চেষ্টা করতেন। বলা বাহুল্য, এটাই বেলায়েতের প্রকৃত লক্ষণ। কবির ভাষায়, ‘নেয়নি কেড়ে হৃদয়-মন একটি বিষয়, কেড়ে নিয়েছে মোর মন দু’চার বিষয়, জান কি তুমি সে সব বিষয় আমার? বলায়, চলায়, কাজে ও আচরণে গাম্ভীর্যের বলয়।

ইসলামের ইতিহাসের বিশিষ্ট গবেষক ও সুপণ্ডিত প্রফেসর ড. শব্বির আহমদ তাঁর গুণাবলীর অকপট স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, ‘তাঁর সুমহান জীবনচরিত, পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব, নিঃস্বার্থপরায়ণতা, নিষ্কলুষ জিন্দেগি ও উত্তম চরিত্র মাধুরী এবং মানবীয় এ গুণগুলো তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে নৈতিক ও মানবিক উচ্চাসনের সর্বোচ্চ শিখরে।

তিনি ছিলেন গীবত ও পরনিন্দা মুক্ত :

আমাদের দেশে প্রায় সর্বত্র দেখা যায় ২ দু’জন ব্যক্তি একত্রিত হলেই ৩য় জনের গীবত সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আলেমগণ গীবত-পরনিন্দার বিরুদ্ধে ওয়াজ করলেও তাদের সাথে বসলে, তাদের মাহফিলে গেলে প্রায়শ দেখা যায় তারা অহরহ গীবত-শেকায়েতে আকণ্ঠ ডুবে আছেন। শাহ্ মাওলানা কুতুব উদ্দিন (রহ.)কে কখনো কারো সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক কাজে তিনি কখনো একের বিরুদ্ধে আরেকজনকে লেলিয়ে দেননি। কোন পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে কটুকথা বলেননি। বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক আন্দোলন, ক্ষমতার পালাবদল কতকিছু ঘটেছে। তিনি সব শুনেছেন, দেখেছেন কিন্তু কোনরূপ মন্তব্য থেকে বিরত ছিলেন। কেউ বলতে পারবেনা, কোন মাহ্ফিলে অন্য কোন আলেমকে, অন্যকোন দল বা দরবারকে তিনি হেয় প্রতিপন্ন করে গালি দিয়েছেন। আর ফতওয়াবাজি! তিনি কখনো ওসবের ধারে কাছে যাননি।

গ্রন্থ রচনা :

শাহ্সূফি মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) যেমন একজন আধ্যাত্মিক সাধক, সফল ও সুযোগ্য শিক্ষক, কামিল পীর ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ লেখক। ইসলামের খিদমতের সকল ক্ষেত্রেই তিনিই সফলতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। ওয়াজ-নসিহত, তা‘লিম-তরবিয়াত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি ছোট-বড় বইপত্রও রচনা করে গিয়েছেন। তাঁর লিখিত ও অনূদিত গ্রন্থগুলো হলো-

১. জান্নাতী ও জাহান্নামী যারা (অনুবাদ গ্রন্থ)

২. বেশারাতুল ইখওয়ান ফি খাওয়াচ্ছিল কুর’আন

৩. মুসতাজাবুদ দাওয়াত

৪. কাশেফে হাজাত

৫. কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে তরিকতের মূলনীতি

৬. গুলহায়ে আকীদত (কবিতা সমগ্র)

৭. নির্বাচিত ভাষণ (ওয়াজ সংকলন-১)।

৮. হেদায়েতের আলো (ওয়াজ সংকলন-২)।

তাছাড়া শিশু-কিশোরদের মাঝে ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার প্রচার করার মানসে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়া’ নামে স্বতন্ত্র একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হয়ে আসছে। তিনি আমৃত্যু জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী মাসিক দ্বীন দুনিয়ার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্রিকার বেচা-বিক্রিতে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন।

হজ্ব পালন ও বিভিন্ন দেশ সফর :

তিনি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইন্তেকালের দু’বছর আগ (২০১৭ ইং.) পর্যন্ত ৫২ বারের অধিক পবিত্র হজ্ব ও ওমরাহ পালন করেছেন। ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ইরাক, সুইজারল্যান্ড, জর্ডান, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বহু দেশ সফর করেছেন।

তাঁর পুত্র-কন্যা :

পারিবারিক জীবনে তিনি এক পুত্র ও ছয় কন্যার জনক। পুত্র-কন্যারা সুশিক্ষিত এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা হলেন, মোছাম্মৎ হান্নানা বেগম, মোত্মাইন্নতুল জন্নাত কাওছার, মাওলানা মোহাম্মদ ছলাহ উদ্দিন বেলাল, মোছাম্মৎ তছনীমা বেগম, উম্মে রুম্মান শমা, উম্মে হানি রৌনক, মোকাররামাতুল জন্নাত আমন্।

স্মর্তব্য যে, আমি ১৯৮৪ সাল হতে ইন্তেকাল পর্যন্ত পীর সাহেব হুজুর হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) এর একান্ত স্নেহ-সান্নিধ্যে একটানা ৩৬ বছর (৩ যুগ) কাটিয়েছি। তিনি ছিলেন উন্নত আখলাক সম্পন্ন একজন আদর্শ মুসলিম মনীষী। পরিচ্ছন্নতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সৌজন্যবোধ, সহমর্মিতা ও সময়ানুবর্তিতায় তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর সাথে সফর, পবিত্র হজ্ব ও ওমরাহ্ পালন ছিল শিক্ষামূলক ও আনন্দদায়ক। তাঁর অপূর্ব সুন্দর নূরানী চেহারা দেখলে আমার চক্ষু শীতল হতো আর তাঁর সুমিষ্ট কথা শুনলে আনন্দে মন ভরে যেত।

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ এই উদার হৃদয় মহৎ ব্যক্তি, হক্কানী আলেমে দ্বীন ও সমাজ হিতৈষীকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে দাখিল করুন। আমীন।

লেখক : মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ, সম্পাদক, মাসিক দ্বীন দুনিয়া ও শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়া।


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *