Bahrul Ulum Hazrat Shah Maulana Muhammad Qutub Uddin Rh.
বাহরুল উলূম হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দীন (রহ.)
মানবজীবনের ইতিহাসে এমন কিছু মহান মানুষ আবির্ভূত হন, যাঁরা সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করে হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে পথ দেখানো উজ্জ্বল দিশারী।
বায়তুশ শরফের পরম শ্রদ্ধাভাজন পীর ছাহেব কেবলা, বাহরুল উলূম হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দীন (রহ.)
-ছিলেন তেমনই এক আলোকদ্রষ্টা, যাঁর জীবন শরীয়ত, ত্বরীকত ও মারিফতের সমন্বয়ে দীপ্ত, আর যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ইলম, আমল ও খেদমতের অনন্য দৃষ্টান্ত।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার আধুনগর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী সূফী মিয়াজী পাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। শৈশব থেকেই তিনি জ্ঞানের প্রতি ছিলেন অগাধ অনুরাগী। প্রথমে চুনতী হাকিমিয়া আলিয়া মাদ্রাসা এবং পরে চট্টগ্রাম শহরের দারুল উলূম আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ১৯৫৯ সালে কামিল পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা বোর্ডে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করে তিনি প্রমাণ করেন তাঁর অসাধারণ মেধা ও সাধনা। সেই কারণেই তাঁকে যথার্থই ‘বাহরুল উলূম’—জ্ঞানের সাগর—উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়।
তিনি ছিলেন শায়খুল হাদিস, প্রাজ্ঞ মুফাস্সির, এবং আরবি-ফার্সি-উর্দু ভাষায় দারুণ দক্ষ এক বিদগ্ধ পণ্ডিত। বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় সেরা অধ্যক্ষের স্বীকৃতি। তবে তাঁর পরিচয় কেবল শিক্ষাবিদ হিসেবে সীমিত ছিল না। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক, সমাজসংস্কারক এবং ত্বরীকতের মহাগুরু। তাঁর বয়ান মুক্তার মালার মতো ঝলমলে ছিল—যা লক্ষ শ্রোতার হৃদয়ে নূরের সঞ্চার করত। তাঁর উপদেশ হৃদয়ের গহীনে আলো জ্বালাত, আর সেই আলো আজও অম্লান হয়ে আছে।
তিনি ছিলেন একজন যুগশ্র্রেষ্ঠ মহান আল্লাহর অলি। তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার শুরু বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম হযরত শাহ মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতর (রহ.) ও হাদিয়ে যমান শাহ সূফী হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ.)-এর সান্নিধ্যে। তাঁদের আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি হয়ে তিনি ১৯৯৮ সালে বায়তুশ শরফের পীরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুদিন পর্যন্ত আত্মশুদ্ধি, আল্লাহভীতি ও রাসূলপ্রেম, তাকওয়ার পথে মানুষকে আহ্বান করে গেছেন। তাঁর হাতে দীক্ষা নিয়ে অসংখ্য মানুষ পেয়েছে অন্তরের প্রশান্তি ও সত্যপথের দিশা।
তিনি ছিলেন কলমের সাধকও। লিখেছেন ’জান্নাতী ও জাহান্নামী যারা,’ ‘কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে ত্বরীকতের মূলনীতি’, ‘বেশারতুল ইখওয়ান ফী খাওয়াছিল কুরআন’ -প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্থ। সহস্রাধিক কবিতার সঙ্কলন ‘গুলহায়ে আকীদাত’ কাব্যগ্রন্থে তিনি আরবি, ফার্সি ও উর্দু কবিতার এক অপূর্ব ভুবন সৃষ্টি করেছেন।
তবে তাঁর আসল পরিচয় বয়ান, গ্রন্থ বা পুরস্কারের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছিলেন দরিদ্র-দুঃখী মানুষের অভিভাবক, অসহায়দের আশ্রয়দাতা। তাঁর অন্তর ভরা ছিল আল্লাহর প্রেম ও রাসূলের প্রেমে। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন আশেকে রাসূল।
২০২০ সালের ২০ মে, পবিত্র রমজানের শবে কদরের মহিমান্বিত দিনে তাঁর ইন্তেকাল যেন ছিল তাকদীরের এক বিশেষ উপহার। যে রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম, সে রাতেই আল্লাহ তাঁকে ডেকে নিলেন। এটি ছিল তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের পূর্ণতা ও আল্লাহর নৈকট্যের প্রতিফলন।
বাহরুল উলূম হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দীন (রহ.) ছিলেন এমন এক আলোকবর্তিকা, যার আলো শুধু তাঁর সমকালে সীমাবদ্ধ নয়—বরং যুগে যুগে মানুষকে পথ দেখাবে। তাঁর জীবনগাথাঁ কথায় শেষ করা যায় না, শুধু হৃদয়ে ধারণ করা যায়। যেমন সূর্যের পরিচয় সূর্য নিজেই বহন করে, তেমনি তাঁর পরিচয় নিহিত তাঁর কর্মে, তাঁর আধ্যাত্মিক আলোয়।
তিনি বাস্তব জীবনে ধারণ করেছিলেন এই দোয়ার মর্মার্থ—
إِلٰهِي أَنْتَ مَقْصُودِي، وَرِضَاؤُكَ مَطْلُوبِي، تَرَكْتُ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا۔
(ইলাহি আনতা মাকসূদি, ওয়া রিদ্বাউকা মাত্বলুবি, তারাকতুদ-দুনিয়া ওয়ামা ফীহা)
অর্থাৎ: হে আল্লাহ! তুমি-ই আমার একমাত্র কাম্য, আর তোমার সন্তুষ্টিই আমার অভীষ্ট। আমি দুনিয়া ও এর ভেতরের সবকিছু ত্যাগ করেছি।
এ দোয়াকেই তিনি জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। 🌹