চুনতী সীরাত ময়দানে শাহ কুতুব উদ্দীনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস ও দীপ্তিময় ভূমিকা

চুনতী সীরাত ময়দানে শাহ কুতুব উদ্দীনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস ও দীপ্তিময় ভূমিকা

প্রস্তাবনা

বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আছে, যা শুধু কোনো অঞ্চলের নয়, বরং পুরো জাতির জন্য হয়ে ওঠে গৌরবের প্রতীক। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতী এমনই এক পবিত্র ভূমি, যেখানে বিগত পাঁচ দশক ধরে গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সীরাত মাহফিল। এটি শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি হলো ইসলামের প্রতি ভালবাসা, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি অগাধ ভক্তি এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের এক মহান আলোকবর্তিকা।

‍“হাম মাজারে মুহাম্মদ (স.) পে মর জায়েঙ্গে,

জিন্দেগি মে য়াহি কাম কর জায়েঙ্গে।“

(হযরত মুহাম্মদ (.)’ উদ্দেশ্যে আমার জীবন উৎসর্গিত,

সারা জীবন তাঁর ধ্যানেই আমি থাকব নিয়োজিত)।

এ শের পড়তে পড়তেই ১৯৭২ সালে এই মাহফিলের যাত্রা শুরু হয় আশেকের রাসূল শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.) শাহ সাহেব কেবলার হাত ধরে। আর এই মাহফিলের আত্মা, প্রাণ ও প্রেরণা হয়ে আবির্ভূত হন বায়তুশ শরফের পীর, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, ওয়াজের ময়দানের সিংহ, সুললিত কণ্ঠের অধিকারী, অতুলনীয় শায়েরবাহরুল উলূম হযরত শাহ মাওলানা শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)। বর্ণাঢ্য একাডেমিক ক্যারিয়ার সম্পন্ন, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহান আলিমে দ্বীন ছিলেন একাধারে মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ, সুললিত কণ্ঠের ওয়ায়েজ, আরবি ও উর্দু ভাষার বিশিষ্ট শায়ের, শ্রেষ্ঠ প্রিন্সিপাল, সর্বোপরি বায়তুশ শরফ দরবারের সালেক ও রাহবার।

ইতিহাস প্রবর্তন

চুনতী সীরাত ময়দান মূলত একটি স্বপ্নের ফসল। সেই স্বপ্নের নাম—রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সীরাতের আলোকে একটি মহাসমাবেশ

  • প্রতিষ্ঠাতা: আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.), ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ, ১৯৮৩ সালের ১৯৮৩ সালের ২৯ নভেম্বর ১৪০৪ হিজরীর ২৩শে সফর ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্র।
  • শুরুর সাল: ১৯৭২ সালে তিনি এই মাহফিলের সূচনা করেন।
  • উদ্দেশ্য: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবনকথা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া, মিলাদ ও সীরাত সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য খাদ্য ও আতিথেয়তার ব্যবস্থা করা।

তাঁর এই উদ্যোগ অল্প সময়েই এক বিরল দৃষ্টান্তে পরিণত হয়।

শাহ কুতুব উদ্দীনের আগমন দীপ্তিময় ভূমিকা

চুনতী সীরাত ময়দানের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হয় যখন শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.) এর মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে।

তিনি ছিলেন—

  • বায়তুশ শরফের পীর: আধ্যাত্মিকতার দিশারী
  • প্রখ্যাত মুহাদ্দিস: কুরআন ও হাদীসের জ্ঞানভাণ্ডার
  • ওয়াজের ময়দানের সিংহ: যুক্তি, দলীল ও আবেগের সমন্বয়ে হৃদয়স্পর্শী কণ্ঠস্বর
  • অতুলনীয় শায়ের: যার কবিতার পঙ্‌ক্তি শ্রোতাদের অন্তর ভেদ করত

৫০ বছরের বর্ণাঢ্য ওয়াজের ধারাবাহিকতা

১৯৭০-এর দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি প্রায় পাঁচ দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে চুনতী সীরাত ময়দানের মঞ্চ আলোকিত করেছেন

  • প্রতি বছর শেষ দিন প্রায় লাখো মানুষের সমাগম হতো কেবল তাঁর কণ্ঠ শুনতে।
  • তাঁর ওয়াজে থাকতো—
    • অতুলনীয় জ্ঞানের স্ফূরণ- বাহরুল ঊলূমের জ্ঞানের ঝর্ণায় মানুষ সিক্ত হতো।
    • প্রতিটি আলোচনা হতো তাঁর বিষয় ভিত্তিক, রেফারেন্সধর্মী- এটি মানুষকে নির্বাক দিশেহারা করে দিত!
    • রাসূল ﷺ-এর জীবন থেকে নেয়া শিক্ষা
    • কুরআনের ব্যাখ্যা ও হাদীসের মর্ম
    • মানবসমাজের সংস্কার
    • যুবসমাজকে আলোর পথে ডাকার আহ্বান
  • তাঁর সুললিত কণ্ঠস্বর ও শায়েরির মিশ্রণে প্রতিটি বয়ান রূপ নিত কবিতার মতো আবেগঘন দাওয়াতি রূপে।

তাই তাঁকে মানুষ ডাকত—বাহরুল উলূম, ওয়াজের ময়দানের সিংহ

মাহফিলের বৈশিষ্ট্য

চুনতী সীরাত ময়দান শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং পুরো দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ সীরাত মাহফিলে রূপ নিয়েছে।

. দীর্ঘ সময়কাল

  • টানা ১৯ দিন ধরে মাহফিল চলে।
  • প্রতিদিনের সেশনই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কেন্দ্রিক।

. লক্ষ লক্ষ মানুষের আতিথেয়তা

  • একসাথে লাখো মানুষকে আপ্যায়নের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
  • ইসলামী আতিথেয়তার এ এক জীবন্ত উদাহরণ।

. আন্তর্জাতিক পরিধি

  • স্থানীয় থেকে জাতীয়, আর জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাহফিল প্রসারিত হয়েছে।
  • বিদেশ থেকেও বহু আলেম, গবেষক ও সাধারণ মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন।

. নিরবচ্ছিন্ন ধারা

  • ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত একবারও বন্ধ হয়নি।
  • রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা—কোনো কিছুই এর প্রবাহ থামাতে পারেনি।

শাহ কুতুব উদ্দীনের ৫০ বছরের বর্ণাঢ্য আলোচনা, ওয়াজ, বক্তব্য চুনতীর ঐতিহাসিক সীরাত ময়দানকে শুধু একটি মাহফিলের সীমায় আবদ্ধ রাখেনি; বরং এটি হয়েছে—

সমাজে প্রভাব উত্তরাধিকার

  • নৈতিক জাগরণের সূতিকাগার
  • তরুণ প্রজন্মের আত্মশুদ্ধির দাওয়াতি কেন্দ্র
  • আন্তর্জাতিক ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রতীক

আজও তাঁর শায়েরি ও হৃদয়গ্রাহী ওয়াজের অনুরণন ভেসে আসে চুনতীর বাতাসে।

এখনো মানুষ, ভক্ত অনুরক্ত, মুরীদীন মুহিব্বীন- এ ময়দানে কাঁদিয়ে বুক ভাসায়- হায় জ্ঞানের সাগর কুতুব উদ্দীন আপনি আপনার সমস্ত জ্ঞান সাথে নিয়ে কোথায় দাফন হয়ে গেলেন-

জমী রু-তী, জঁমা- রু-তা ফলক আঁসূ বহাতাহে

উপসংহার

চুনতী সীরাত ময়দান ইসলামের আলোয় দীপ্ত এক মহাসমাবেশ, যার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাফেজ আহমদ (রহ.)। কিন্তু এর প্রাণস্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.), যিনি টানা পাঁচ দশক ধরে তাঁর সুললিত কণ্ঠে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়কে কুরআন-সুন্নাহর আলোয় আলোকিত করেছেন।

তিনি শুধু একজন বক্তা নন; তিনি ছিলেন এক যুগের প্রেরণা, দাওয়াতের দিশারী এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পতাকাবাহক।
চুনতী সীরাত ময়দান তাঁর দ্বীনি উত্তরাধিকারের উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে আগামী প্রজন্মের জন্যও অটুট আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *