✨ জ্ঞানচর্চার পথিকৃত: শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)
শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.) ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহর ওলি। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল ইলম ও মারেফাতের দীপ্ত আলোকশিখা এবং জ্ঞান সাধনার অগ্রদূত। শৈশবকাল থেকেই তিনি জ্ঞান অর্জনের পথে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ইলম চর্চা ও প্রচারে অবিচল ছিলেন। তাঁর জীবন কেবল একজন মানুষের নয়, বরং এক যুগের প্রেরণা।
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জীবন ইতিহাস হলো মানবতার জন্য আলোকিত বাতিঘর। তাদের ত্যাগ, সাধনা ও ইলমের দীপ্তি যুগযুগান্তরের অন্ধকার ভেদ করে মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করে।
তেমনই এক প্রদীপ্ত নাম হলো— বাহরুল উলূম শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)।
তিনি শুধু একজন আলেম নন; আলেমদের মাথার তাজ। ছিলেন ইলমের মহাসমুদ্র, আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং জ্ঞানচর্চার এক অনন্য পথিকৃত।
🌱 শৈশব ও শিক্ষাযাত্রা
শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.) শৈশবকাল থেকেই আল্লাহর ইলমের প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ছোট্ট বালক বয়সেই তিনি আল্লাহর বাণী ও প্রিয় নবীর হাদীসের প্রতি এক অদম্য আকর্ষণ অনুভব করেন।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন লোহাগাড়া চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদরাসা থেকে। সেখানেই তাঁর জ্ঞানের বীজ অঙ্কুরিত হয়। অতঃপর জ্ঞানের উচ্চতর স্তরে পৌঁছার জন্য তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম চন্দনপুরা দারুল উলূম কামিল মাদরাসায়। সেখানে তিনি অধ্যবসায়, মেধা ও অধ্যয়ন মনোযোগের মাধ্যমে সবার কাছে অনন্য হয়ে ওঠেন।
আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে তিনি এ মাদরাসা থেকে স্বর্ণপদক অর্জন করেন এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রী কামিল লাভ করেন। এটি প্রমাণ করে যে তিনি শুধু আধ্যাত্মিকতার নয়, বরং একাডেমিক ক্ষেত্রেও ছিলেন অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী।
👉 এভাবেই তিনি জ্ঞানসাধনার বাগানে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেন অনন্য এক গোলাপ, যার সুবাস যুগ থেকে যুগে ছড়িয়ে পড়েছে।
👉 ছাত্র হিসেবে তাঁর জীবনের প্রতিটি দিন প্রমাণ করেছে— ইলম কোনো বিলাসিতা নয়, বরং তা আল্লাহর পথে এক আজীবন সাধনা।
📚 ইলমের সাগরে অবগাহন: “বাহরুল উলূম”
অধ্যয়ন, গবেষণা ও জ্ঞানবিস্তারে তাঁর অতুলনীয় পারদর্শিতার কারণে তিনি পেয়েছিলেন মহিমান্বিত উপাধি—
“বাহরুল উলূম” (ইলমের সাগর)।
তিনি দিনকে দিন এবং রাতকে রাত জ্ঞান সাধনায় অতিবাহিত করতেন।
বিশেষ করে রাতের শেষ প্রহর ছিল তাঁর জ্ঞান সাধনার উজ্জ্বল অধ্যায়।
মানুষ যখন ঘুমে বিভোর, তখন তিনি তাহাজ্জুদ নামাযে অশ্রু বিসর্জন করতেন।
এরপর ফজরের আজান পর্যন্ত ডুবে থাকতেন হাদীস ও তাফসীর অধ্যয়নে।
👉 তাঁর এ সাধনা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় রাসূল ﷺ এর বাণী:
“যে ব্যক্তি জ্ঞান অনুসন্ধানের জন্য পথে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।”
— (সহিহ মুসলিম, হাদীস 2699)
👉 শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)-এর জীবন এই হাদীসের বাস্তব রূপ।
তিনি শুধু পড়তেন না, বরং ডুবে যেতেন ইলমের গভীরে।
📚 ইসলামে জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব ও তাঁর জীবন
১. জ্ঞান অর্জন ফরজ
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
“প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।”
— (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদীস 224)
👉 শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.) এ হাদীসের মর্ম হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবনই প্রমাণ করে যে তিনি ছোটবেলা থেকে মৃত্যুপূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইলমের জন্য নিবেদিত ছিলেন।
শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)-এর বৈশিষ্ট্য ছিল—
- রাতের গভীরে তাহাজ্জুদ নামাযে অশ্রু বিসর্জন,
- আর ভোর পর্যন্ত হাদীস ও তাফসীরের জ্ঞানচর্চা।
👉 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি রাতে কিয়াম (তাহাজ্জুদ) পড়ে এবং সকালে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করে, সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা।”
— (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)
তাঁর এ জীবনধারা প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন ইলম ও ইবাদতের সমন্বয়ে সিদ্ধ পুরুষ।
তাঁর ইবাদত ও ইলম ছিল একে অপরের সহচর।
দিনের বেলায় তিনি ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন, মুরীদদের তালীম দিতেন, সমাজে ইলমের আলো ছড়িয়ে দিতেন।
আর রাতের গভীরে তিনি ছিলেন ইলম ও ইবাদতের সমাহারে আল্লাহর একান্ত বান্দা।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ
“আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের মর্যাদা অনেক উচ্চ করবেন।”
— (সুরা মুজাদিলা, আয়াত 11)
👉 সত্যিই, শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)-এর মর্যাদা আল্লাহ ইলম ও তাকওয়ার মাধ্যমে উচ্চ করেছিলেন।
তাঁর জীবনে ইলম ও ইবাদত ছিল অবিচ্ছেদ্য।
- দিনে তিনি ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন, মুরীদদের তালীম দিতেন, সমাজে ইলমের আলো ছড়াতেন।
- রাতে তিনি নিজেকে সঁপে দিতেন আল্লাহর দরবারে—তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত আর গবেষণার মধ্য দিয়ে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ
“আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের মর্যাদা অনেক উচ্চ করবেন।”
— (সুরা মুজাদিলা, আয়াত 11)
👉 আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনেই।
🌟 প্রেরণার বাতিঘর
তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—
- ইলম শুধু পাঠ্যপুস্তকের অক্ষরে সীমাবদ্ধ নয়,
- বরং ইলম হলো আত্মার খাদ্য, অন্তরের আলো, ইবাদতের সহচর।
শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)-এর শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল জ্ঞান সাধনা প্রমাণ করে—
👉 একজন সত্যিকারের অলি মানেই তিনি ইলম ও আমলের সমন্বিত রূপ।
🌟 সমাজে তাঁর প্রভাব
শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.)-এর ইলম ছিল না শুধু মসজিদ-মাদরাসার চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ।
তাঁর জ্ঞান, দাওয়াত ও আধ্যাত্মিক আলো পৌঁছে গিয়েছিল জনমানুষের হৃদয়ে।
তিনি ছিলেন দরবেশদের মুর্শিদ, আলেমদের শিক্ষক, সাধারণ মানুষের পথপ্রদর্শক।
যেখানে অন্ধকার, তিনি সেখানে আলো জ্বালাতেন।
যেখানে অজ্ঞতা, তিনি সেখানে জ্ঞানের বীজ রোপণ করতেন।
✨ উপসংহার
তাঁর শিক্ষাজীবন আমাদের শেখায়— সত্যিকারের অলি হওয়া মানে জ্ঞান ও তাকওয়ার সমন্বয়।
শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.) শুধু আধ্যাত্মিকতার নয়, বরং জ্ঞানচর্চার দিক থেকেও ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহর অলি। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জন্য দিশারী।
তিনি সত্যিই “বাহরুল উলূম”— ইলমের অফুরন্ত সাগর।
বাহরুল উলূম শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.) ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র, ছিলেন ইলমের বাতিঘর।
তাঁর জীবন কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির গল্প নয়; বরং এটি যুগযুগান্তরের জন্য এক মহা প্রেরণা।
আজও তাঁর নাম উচ্চারণ করলে হৃদয় জুড়ে ওঠে শ্রদ্ধা, আর আত্মা খুঁজে পায় আলোকিত দিশা।
বাহরুল উলূম শাহ কুতুব উদ্দীন (রহ.) ছিলেন এক অনন্য সাধক, যিনি ইলম ও ইবাদতের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক আলোকিত জীবন।
শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর জ্ঞান সাধনা প্রমাণ করে—
👉 সত্যিকারের ওলি কেবল আধ্যাত্মিকতায় নয়, বরং ইলম ও তাকওয়ার মহিমায় মহিমান্বিত হন।
তাঁর নাম আজও আলোকবর্তিকা হয়ে আছে, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—
ইলমের পথে হেঁটেই পৌঁছানো যায় আল্লাহর নৈকট্যে।
-নুরুদ্দীন মাহমুদ
Leave a Reply